সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

নজরুল: একজন সাহসী সাংবাদিকের প্রতিকৃতি




মৃত্যুকে শাসাই-বলি, তোর মরে যাওয়া ভাল, যেমন মরেছে সাদা ঘাসের সকল প্রেম। নিজের লেখা কবিতার মত মৃত্যুকে শাসাতে পারেননি। বরং সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে, স্বপ্ন দেখাতে গিয়ে নিজেই একদিন স্বপ্নের দ্রুবতাঁরা হয়ে গেলেন। হা, আমি বরিশাল বিএম কলেজের একজন বিপ্লবী ছাত্রনেতা এবং আপোষহীন সাংবাদিক দৈনিক ইত্তেফাকের বরিশাল সংবাদদাতা নজরুল ইসলামের কথা বলছি। নজরুল একজন ছাত্রনেতা হিসাবে, একজন সাহসী সাংবাদিক হিসাবে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন এবং ৭১ মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র জনতাকে সংগঠিত করার জন্য, মুক্তির সংগ্রামে সামীল করার জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন গোটা দক্ষিনাঞ্চল। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তখন জাসদ ছাত্রলীগের জয়জয়কার। তারুণ্যের হাওয়া দক্ষিনাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও লেগেছিল। অঞ্চলের ছাত্র -জনতাকে সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবী আদর্শে  উদ্দীপ্ত করার অন্যতম সংগঠক নজরুল।


নজরুলের জম্ম ১৯৫৩ সনের ২৯ জুলাই বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার চাওড়া চন্দ্রা গ্রামের এক রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবারে। বাবা আলী হোসেন হাওলাদার ছিলেন ধনাঢ্য ব্যক্তি এবং একজন সৌখিন থিয়েটার অভিনেতা। তখনকার সময়ে শিল্প-সাংস্কৃতিক অঙ্গন ছিল হিন্দু প্রভাবিত। এরমধ্যেও আমতলীর যে কজন মুসলিম পরিবারের সদস্য শিল্প-সংস্কৃতির সাথে যুক্ত হয়েছিলেন আলী হোসেন হাওলাদার তাদের অন্যতম। তিনি যুক্ত ছিলেন পাকিস্থান আর্টস কাউন্সিলের সাথে। নজরুল ইসলাম ছিলেন বাবা মায়ের ছেলে এবং মেয়ের  মধ্যে দ্বিতীয়। বড় ভাই শাহজাহান তার সাথেই আমতলী একে হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে সৈয়দ হাতেম আলী কলেজে এইচএসসি পড়ছিল এবং সেজভাই শওকত আলী চুন্নুকে ভর্তি করিয়েছিল বরিশাল বিএম স্কুলে। কিন্তু নজরুল মারা যাওয়ার পর তারা পালিয়ে আসেন। এমনকি তার মামা আনোয়ার হোসেন বিএম কলেজে অর্থনীতি বিভাগে ¯œাতক (সম্মান) শ্রেণীতে পড়তেন এবং একই রুমে থাকতেন। সেও বরিশাল শহর ছাড়তে বাধ্য হন এবং এক বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। বর্তমানে সে আমতলী সরকারী কলেজে প্রভাষক হিসাবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে আছেন। বর্তমানে নজরুলের ভাই এবং বোন রয়েছে। ৪র্থ ভাই মো: মহসীন বরিশাল বিএম কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেছেন এবং আমতলীতে আইন ব্যবসা করছেন। সে ১৯৯৭-২০০৩ মেয়াদে চাওড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বর্তমানে বরগুনা জেলা বার এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি (আমতলী) দায়িত্ব পালন করছেন। ৫ম ভাই মহিউদ্দিন খোকন বরিশাল বিএম কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞানে অনার্স করেছেন। বর্তমানে চাওড়া নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। নজরুলের ছোট ভাই এ্যাডভোকেট শাহাবুদ্দিন পাননাও বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করেন। তার পথ ধরেই দৈনিক ইত্তেফাকে আমতলী উপজেলা সংবাদদাতা হিসাবে এবং The Daily Observer’ বরগুনা জেলা সংবাদদাতা হিসাবে কাজ করছে। বর্তমানে সে আমতলী প্রেসক্লাবের সভাপতি এবং নজরুলের স্মৃতি রক্ষার্থে প্রতিষ্ঠিত নজরুল স্মৃতি সংসদ-এনএসএস এর নির্বাহী পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছে। বোনের মধ্যে হেলেনা বেগম, জাকিয়া আক্তার বুলা, ইসরাত জাহান কানন আমতলীতেই বসবাস করেন ছোট বোন ফাইজুন নাহার কিসমতও বরিশাল বিএম কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স করে বরিশালেই বসবাস করেন। মা রিজিয়া বেগম ৩রা আগস্ট, ১৯৯৬ সনে  এবং বাবা আলী হোসেন হাওলাদার ৩রা ডিসেম্বর, ২০০০ সনে  ইন্তেকাল করেন।
নজরুলের শিক্ষা জীবন শুরু হয় পারিবারিক পরিমন্ডল থেকে। প্রাথমিক শিক্ষা পূর্ব পাতাকাটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৬২ সনে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ১৯৬৩ সনে ৬ষ্ট শ্রেনীতে ভর্তি হন আমতলী একে  হাই স্কুলে। ১৯৬৮ সনে নজরুল আমতলী একে হাই স্কুল থেকে মানবিক শাখায় এসএসসি পাশ করেন। একই বছর ভর্তি হন প্রাচ্যের অক্সফোর্ট বরিশাল বিএম কলেজে। ১৯৭০ সনে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। দেশ স্বাধীন হলে অন্যদের মত নজরুলও আবার বিএম কলেজে ফিরে আসেন এবং তৎকালীন অধ্যক্ষ ইমদাদুল হক মজুমদার এবং অর্থনীতি বিভাগের প্রধান প্রফেসর মোহাম্মদ হানিফ এর উৎসাহে অর্থনীতি বিভাগ স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীতে ভর্তি হন।

১৯৬৮ সন। তখন গোটা দেশ টালমাটাল। একদিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে ফুসে উঠছে ছাত্র-জনতা অন্যদিকে ১১ দফার ভিত্তিতে জোটবদ্ধ হচ্ছে ছাত্র সংগঠনগুলো। স্কুল জীবন থেকেই আইউব বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকলেও বিএম কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত হয়ে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। অসাধারণ বক্তৃতা, সাধারণ জীবন-যাপন এবং অত্যন্ত মিশুক প্রকৃতির মানুষটি খুব সহজেই সাধারণ ছাত্র এবং নেতাদের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেন। এই অস্থির সময়ে অনুষ্ঠিত হয় বরিশাল বিএম কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন। নজরুল এজিএস নির্বাচিত হন আলতাফ হোসেন খান ভুলুর প্যানেলে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে যে প্রগতিশীল অংশ ৬২ নিউক্লিয়াসের সাথে যুক্ত হয়ে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছিলেন বরিশালে এ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্নার নেতৃত্বে নজরুল এই ধারার সাথে যুক্ত হন। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র জনতাকে সংগঠিত করার জন্য তিনি গোটা দক্ষিনাঞ্চল চষে বেড়ান। ১৯৭০ সনের  সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রার্থীর পক্ষে তার ভূমিকা ছিল অসাধারণ। ১৯৭১ সনের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে ছাত্র জনতাকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে নজরুল সাহসী ভূমিকা রাখেন।

দেশ স্বাধীন হলে ক্যাম্পাসে ফিরে এসে ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত হয়ে আবার শুরু করেন ছাত্র রাজনীতি। তখন ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ বিরোধ প্রায় প্রকাশ্য। ১৯৭২ সনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ দুভাগ হয়ে যায়। একদিকে সিরাজুল আলম খানের নেতেৃত্বে আসম আবদুর রব এবং শাজাহান সিরাজ অন্যদিকে শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে নুরে আলম সিদ্দিকী এবং আবদুস কুদ্দুস মাখন। বরিশালের রাজনীতির পালেও হাওয়া লাগে। আবদুল বারেক, এনায়েত হোসেন চৌধুরী, ডা: আজিজ রহিম, এ্যাডভোকেট জ্ডে আই খান পাননা নজরুল ইসলাম ছাত্রলীগ রব-সিরাজ যুক্ত হন। পরে নজরুল জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের বরিশাল জেলা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৩ সনে নজরুল বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ থেকে নজরুল-জাফর-রফিক পরিষদে ভিপি নির্বাচন করেন। নির্বাচনে নজরুল-জাফর-রফিক প্যানেল বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল ঘোষনা করতে পারেনি। তবে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের হৃদয়ে নজরুল বিএম কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি জায়গাটি দখল করে নেন। নজরুল-জাফর-রফিক প্যানেলে জিএএস পদে নির্বাচন করেন জাফর হোসেন। তার বাড়ি বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলায়। জাফর হোসেন ১৯৭৩ সনের ১৭ মার্চ জাসদ কর্তৃক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও কর্মসুচিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এজিএস পদে নির্বাচন করেন গাজী রফিকউদ্দিন আহমেদ। তার বাড়ি বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলায়। তিনি সরকারী কর্মকর্তা হিসাবে অবসর গ্রহণ করে বর্তমানে আমতলীতে ঔষধ ব্যবসার পাশাপাশি সামাজিক কর্মকান্ডে যুক্ত আছেন
১৯১৭ সনে রুশ বিপ্লব এবং পরবর্তী সময়ে মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিন বাদে উজ্জীবিত হয়ে বিশ্বব্যাপী কৃষক শ্রমিক ছাত্র-যুবকরা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা বির্নিমানের স্বপ্ন দেখছিল। বন্দুকের নলই সমাজ পরিবর্তনের মূলমন্ত্র স্লোগান দিয়ে ১৯৪৯ সনে চিনে চেয়ারম্যান মাওসেতুং এর সশস্্র বিপ্লবের তত্ত্ব, কিউবায় ফিদেল ক্যাস্ত্রো চেগুয়েভারার সশস্্র বিপ্লব এবং সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবী আদর্শ দেশে দেশে কৃষক শ্রমিক ছাত্র-যুবকরা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা বির্নিমানের স্বপ্ন দেখছিল। বন্দুকের নলই সমাজ পরিবর্তনের মূলমন্ত্র স্লোগান দিয়ে ১৯৪৯ সনে চিনে চেয়ারম্যান মাওসেতুং এর সশস্্র বিপ্লবের তত্ত্ব, কিউবায় ফিদেল ক্যাস্ত্রো ও চেগুয়েভারার সশস্্র বিপ্লব এবং সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবী আদর্শ দেশে দেশে কৃষক শ্রমিক ছাত্র-যুবকদের ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে। সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সশস্ বিপ্লবে ছাত্র-যুবকদের বাধভাংগা জোয়ারের মত এগিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে  উনবিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে জর্জ বার্নাডশ একবার বলেছিলেন, যৌবনে যে প্রেমে পরে না আর মার্ক্সবাদে দীক্ষা নিয়ে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে না-দুজনই অস্বাভাবিক। যৌবনে নজরুলও সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ১৯৬৮ সনে বিএম কলেজে ভর্তি হয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত হলেও ধীরে ধীরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে যে প্রগতিশীল অংশ ৬২’র নিউক্লিয়াসের সাথে যুক্ত হয়ে সশস্্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছিলেন। ১৯৭০ সনে বলাকা ভবনে ছাত্র লীগের যে সভায় স্বপন কুমার চৌধুরী স্বাধীন বাংলাদেশের প্রস্তাব করছিলেন নজরুলও সে সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং জোরালো ভাবে স্বপন কুমার চৌধুরীর প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন। নজরুল সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, জাসদের তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খান এবং ৬২’র নিউক্লিয়াসের অন্যতম নেতা কাজী আরেফ আহমেদের অত্যন্ত ঘনিষ্ট ছিলেন এবং তাদের অনুপ্রেরণায় নজরুল সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন এবং মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিনবাদে উজ্জীবিত হন। চেয়ারম্যান মাওসেতুং, ফিদেল ক্যাস্ত্রো, এন্থনী গ্রামসী, হো চি মিন এবং চেগুয়েভারার বিপ্লবী আন্দোলন তাকেও ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করে। অন্যদিকে নজরুলের ঘনিষ্ট বন্ধু সদরুল আলম ভূইয়া ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং তাত্বিক নেতা। রসায়ন বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীতে পড়তেন এবং যতদুর জানা যায় তার বাড়ি ফেনি জেলার দাগনভুইয়া উপজেলায়। সদরুল জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের বরিশাল জেলা কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন। সমরেশ কুমার মৃধা ছাত্রলীগের বরিশাল জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন । তার বাড়ি পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলায় । সদরুল প্রচার বিমূখ এবং নিভৃতচারী হলেও তার বিপ্লবী আদর্শ নজরুলকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। নজরুল মনে প্রাণেই বিশ্বাস করতেন দেশ স্বাধীন হলেও বিদ্যমান পুজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় কোনভাবেই কৃষক- শ্রমিক-মেহনতি মানুষের মুক্তি আসবে না। এ প্রক্রিয়ায় রার্ষ্ট্রীয় সম্পদ লুন্ঠন বাড়বে, শোষন বৈষম্য বাড়বে-ধনি আরো ধনি হবে। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনেতিক মুক্তির জন্য প্রয়োজন কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে একটি সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। তবে নজরুল সশস্র বিপ্লবের পরিবর্তে গণসংগ্রামকে বেশী গুরুত্ব দিতেন।

নজরুল রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি গল্প, প্রবন্ধ এবং কবিতার মাধ্যমে বাঙালী জাতির স্বপ্ন, মুক্তির আকাঙ্খা তুলে ধরেন। ১৯ শতকের প্রথমার্ধের কবি সাহিত্যিক Théophile Gautier তার উপন্যাস Miss Mopin Gi এর মুখবন্ধে L’art pour L’art কিংবা Art for Art’s sake - শিল্পদর্শন তুলে ধরেন Walter Peter, Oskar Wild, Arther Simon. Edgar Allan Poe এর মত ফরাসী ইংল্যান্ডের বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকরা শিল্প দর্শন অনুসরণ করলেও নজরুল কখনো শিল্প দর্শনে বিশ্বাস করতেন না। নজরুল পাবলো নেরুদা, মানিক বন্দোপাধ্যায়,কাজী নজরুল ইসলাম এবং সুকান্ত  ভট্টাচার্য দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তার লেখা প্রবন্ধ কবিতা বিএম কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিনসহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আমতলী থেকে প্রকাশিত সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, শোক নয় শক্তি  কয়েকটি সংখ্যায় তার কবিতা এবং  একটি ছোট গল্প প্রকাশিত হয়েছিল।
নজরুল একাধারে ছাত্রনেতা, সাংবাদিক-সাহিত্যিক। অবসর সময়ে বসতেন হারমোনিয়াম তবলা নিয়ে। সবাইকে নিয়ে গাইতেন দেশের গান, নজরুল-রবীন্দ্র সঙ্গীত। তার প্রিয় গান জাতীয় সঙ্গীতের পুরোটা, ডিএল রায়ের ধনধান্য পুষ্পভরা রবীন্ত্রনাথের আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার পরে। দরাজ গলায় সবাইকে নিয়ে আবৃত্তি করতেন কারার লোহ কপাট ভেংগে ফেল কররে লোপাট রক্ত জমাট শিকল পুজার পাষান বেধী, সুকান্তের বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন।
ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি নজরুল লেখালেখি করতেন এবং জড়িয়ে পরেন সাংবাদিকতায়। ১৯৭০ সনের ১২ নভেম্বরের প্রয়লংকারী বন্যায় সাংবাদিক হিসাবে উপকুলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কথা তুলে ধরেন। নজরুল বিশ্বাস করতেন, শোষিত বঞ্চিত মানুষের দু:খ কষ্টের কথা তুলে ধরে সমাজের শোষন বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানুষকে জাগিয়ে তুলতে হবে।তিনি মনে করতেন, রণাঙ্গনের হাতিয়ারের মত লেখনিও রুখবে পাকিস্থানী হানাদার আর দেশীয় দোসরদের। ১৯৭১ সনের শেষ দিকে ইত্তেফাকের বরিশাল সংবাদদাতা ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক রফিকুল ইসলামকে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী মেরে ফেললে নজরুল ইসলাম ইত্তেফাকের বরিশাল সংবাদদাতা হিসাবে যোগদান করেন এবং ৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব:) এম.এ জলিলের সাথে থেকে রণাঙ্গনের সংবাদ সংগ্রহ করেন এবং ইত্তেফাক তখন অনিয়মিত প্রকাশনা থাকায় বিভিন্ন সংবাদপত্রে তা প্রকাশ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দৈনিক ইত্তেফাকের বরিশাল জেলা সংবাদদাতা হিসাবে কর্মরত ছিলেন এবং বরিশাল প্রেসক্লাবের সদস্যছিলেন। বরিশাল প্রেসক্লাব প্রতি বছর ১৯ জুন স্বজন স্মরণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নজরুলসহ হারিয়ে যাওয়া সাংবাদিকদের স্মরণ করেন, শ্রদ্ধা জানান।

১৯৭৩ সনের ১০ আগস্ট রাত অনুমান ১০ টা। বাইরে ঘুট ঘুটে অন্ধকার, অল্প অল্প বৃষ্টি হচ্ছে। একজন পরিচিত যুবক সদরুল আপনাকে ডাকে বলে বিএম কলেজের ডিগ্রী হোস্টেলের রুম থেকে নজরুলকে ডেকে নিয়ে গেলেন। নজরুলের কথা বলে ইন্টারমিডিয়েট (মুসলিম ) হোস্টেল থেকে সদরুলকে এবং কলেজ রোড থেকে সমরেশকে ডেকে নিয়ে একদল দুস্কৃতিকারী তাদেরকে গুম করে। নজরুল-সদরুল-সমরেশ ছিল তখনকার সময়ে দক্ষিনাঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে সবচেয়ে উচ্চারিত নাম।

নজরুলের স্মৃতি রক্ষার জন্য তার রাজনৈতিক অনুসারী, বন্ধু-বান্ধব এবং শুভাকাঙ্খীরা ১৯৭৭ সনে নজরুল স্মৃতি সংসদ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। সময়ের প্রয়োজনে ২০০০ সনে People Participation for Social Change স্লোগান নিয়ে নজরুল স্মৃতি সংসদ সংক্ষেপে এনএসএস এনজিও কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৪ সনে সংস্থাটি এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর নিবন্ধন লাভ করে এবং কার্যক্রমের সম্প্রসারণ ঘটে। বর্তমানে এনএসএস বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় দরিদ্র নারী পুরুষ, দুর্যোগ জলবায়ূ পরিবর্তনজনিত ঝুকিতে থাকা  মানুষ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করছে এবং নজরুলের সমতা ভিত্তিক সমাজ বিনির্মানের স্বপ্ন দেখছে    
নজরুল একটি স্বপ্ন। সম সাময়িক সময়ে একটি বিপ্লবী চেতনা। ব্যক্তি নজরুলকে হত্যা করলেও একটি আদর্শ, একটি স্বপ্নকে মেরে ফেলা যায় না। কখনো কেউ পারেনি। নজরুলও  বেচে থাকবেন তার স্বপ্নে, এনএসএস কার্যক্রমের মধ্যে আর সাধারণ মানুষের ভালোবাসায়





মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মামনির জন্মদিন: স্বপ্নের চেয়েও বড় হও।

১৯২৮ সন। পন্ডিত জহরলাল নেহেরু তখন এলাহবাদে। আর ১০ বছরের ইন্দিরা গান্ধী থাকেন হিমালয়ের কোলঘেসে মূসৌরী শহরে। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম চিঠি। নেহেরু প্রায়ই মেয়েকে চিঠিতে প্রকৃতি, পৃথিবী ও মানব সভ্যতার বিকাশসহ ভারতের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে লিখতেন। ১৯২৯ সনের নভেম্বর মাসে এসব চিঠি নিয়ে মা-মনিকে-বাবা নামে একটি বই প্রকাশিত হলে তা ইতিহাসের অংশ হয়ে যায় । বর্তমানে এটি ভারতের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে এবং রেফারেন্স বুক হিসাবে পড়ানো হয়।কুটনৈ তিক ফারুক চৌধুরীর কুটনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা প্রিয় ফারজানাও আমাদের ভ্রমন সাহিত্য ও ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। প্রত্যেক পিতাই দূরে থাকা সন্তানদের প্রতি কিছু পরামর্শ, কিছু নির্দেশনা দিয়ে থাকে। আগে চিঠি লিখত,এখন তার জায়গায় ইমেইল, মোবাইল বা সোশ্যাল মিডিয়া ।এজন্য নির্দেশনাটাও বেশী । এটা কর, ওটা কর না । সন্ধ্যার আগেই বাসায় বা হলে ফের। রাত কর না। রাজনীতিতে জড়িও না, কোটা সংস্কার আন্দোলন কিংবা নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে যেও না। কারন অভিভাবকরা সব সময় সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে, মেয়ে হলে তো কথাই নেই । সন্তানরা হয়ত ভাবে, আমরা বড় হয়েছি এত ট...

শুভ জম্মদিন ও একজন স্বপ্নের ফেরিওয়ালার গল্প ।।

The Wright Brothers  প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই আকাশের দিকে তাকিয়ে পাখির উড়া দেখতেন। দেখতে দেখতে এক সময় পাখির মত আকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। একদিন তাদের স্বপ্ন সফল হল। পাখি হয়ে আকাশে উড়ে নয়, উড়োজাহাজ আবিস্কার করে আকাশ উড়ে। প্রতিটি জীবনে স্বপ্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বপ্ন বা vision জীবনকে guide করে, স্বপ্ন ছাড়া জীবন হচ্ছে সুনির্দিষ্ট গন্তব্য ছাড়া দূরপাল্লার যাত্রার মত। তবে এ স্বপ্ন রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখা নয়। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের মতে স্বপ্ন সেটাই যেটা অর্জনের জন্য আমাদেরকে ঘুমাতে দেয় না। স্বপ্ন দেখানো আরো কঠিন কাজ। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ স্যার সারাটা জীবন জুরেই স্বপ্ন ফেরী করেছেন। বিভিন্ন সভা সমাবেশ বক্তৃতা আর লেখার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নতুন প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ড: জাফর ইকবাল। আমাদের সমাজ জীবনের ক্ষুদ্র পরিসরে প্রতিদিন  Social Media, পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে, চ্যানেলে সাক্ষাতকার, কমিউনিটি রেডিওর টক শোতে এমনকি মাঠে ঘাটে সভা সমাবেশ আর উঠান বৈঠকে যে মানুষটি এ অঞ্চলের তরুন প্রজম্মকে দিন বদলের কথা বলছেন, ...

সুবন্ধি বাধ, একজন জেলা প্রশাসক ও খালের দুপাড়ের অভাগা ৮০ হাজার মানুষ।।

বরগুনা জেলার সকল পর্যায়ের মানুষের খুব  মন খারাপ। ব্যক্তিগতভাবে আমারও। বরগুনা জেলার অত্যন্ত জনপ্রিয় জেলা প্রশাসক, সাধারণ মানুষের খুব কাছের ব্যক্তি  ড: মুহা: বশিরুল আলম চলে গেছেন। বিভিন্ন  মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কারনে জেলা প্রশাসকের চলে যাওয়ার খবর এখন সুবন্ধি খালের দুপাড়ের ৮০ হাজার মানুষের মুখে মুখে। অনেকদিন ঢাকায় ছিলাম। আজকে অফিসেই দেখা হল চন্দ্রা, কাউনিয়া, লোদা এবং মহিষডাঙ্গার কয়েকজনের সাথে। দেখলাম তাদেরও খুব মন খারাপ। ২০০৮ সন থেকে সুবন্ধি বাধের কারনে আমতলী উপজেলার আমতলী, চাওড়া, হলদিয়া ইউনিয়ন  ও আমতলী পৌরসভার প্রায় ৮০ হাজার মানুষের কৃষি, পণ্য পরিবহন, জীবন জীবিকা এমনকি পানি ব্যবহার সংক্রান্ত দৈনন্দিন কাজ কর্ম মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। এ সংবাদ শুনে জেলা প্রশাসক স্যার শুধু নির্দেশনা দিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি নিজের চোখে সমস্যা দেখেছেন,ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কথা শুনেছেন,সমস্যা সমাধানের উপায় বের করার জন্য মিডিয়া, জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে একাধিক বার মতবিনিময় সভা করেছেন। Citizen's  Voice -Barguna এবং Public Service  Innovation Bangladesh এ তুলে ধরে ...