১৯৮৬ সন। আমি তখন বরগুনা সরকারী কলেজের ছাত্র। রাজনৈতিক কারনে বিকালে
আমাদের আড্ডা ছিল বরগুনা বাজার রোডের আবদুল আলিম হিমু সম্পাদিত সাপ্তাহিক
বরগুনা কন্ঠের বিপরিতে সাজুর চায়ের দোকানে। অধিকাংশ সময়ে আড্ডার মধ্যমনি
ছিল জাসদ নেতা সালাম আলমাস চৌধুরী। এক সময়ে তিনি আমতলী কলেজের রসায়ন
বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। ৮৬ সনের জানুয়ারী কি ফ্রেব্রুয়ারী মাস,শীতের
সন্ধ্যায় আমরা সাজুর চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছি। অপরিচিত এক ভদ্রলোক ডুকে
সালাম দিয়ে আমাদের পাশের টেবিলে বসলেন। খুবই সাধারণ পোষাক পরিচ্ছেদ, হাতে
একটি ডায়রী এবং বলার স্টাইল ও উচ্চারণ অনেকটাই স্থানীয় সাদা মাটা । প্রথম
দেখায় খুব একটা ভাল না লাগলেও যখন শুনলাম তিনি বরগুনা আলীয়া মাদ্রাসায়
বাংলা বিভাগের প্রভাষক এবং তার বাড়ি পটুয়াখালী সদর উপজেলার মরিচবুনিয়া
ইউনিয়নে, তখন হঠাৎ করেই তার প্রতি একটা ভাললাগা তৈরী হয়ে গেল। এরপর মাঝেই
মাঝেই তিনি আমাদের আড্ডায় আসতেন এবং দিনে দিনে তিনিও হয়ে উঠলেন আমাদের
আড্ডার অন্যতম আকর্ষন। তার সহজ সরল বলার স্টাইল হাসতে হাসতে কঠিন কথা বলার
কৌশল এবং সাহসীকতা আমাদেরকে খুব আকৃষ্ট করত।
এরপর অনেক দিন
তারসাথে আর যোগাযোগ ছিল না। পরে তিনি আমতলী কলেজে বাংলা বিভাগের প্রভাষক
হিসাবে যোগদান করলেন। আমিও বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করে আমতলীতে ফিরে
আসি সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাপ্তাহিক পায়রাপাড় বের করার উদ্যোগ নেই।
লেখালেখির প্রয়োজনেই আবার সুলতান ভাইর সাথে যোগাযোগ,আবার সেই আড্ডা।বাংলা
সাহিত্যের ছাত্র হিসাবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ত্রিশোত্তর কবিদের প্রতি আমার একটা বিশেষ আগ্রহ ছিল। তার আগ্রহ ছিল পৌরানিক কাহিনী, মহাভারত,বাংলা
সাহিত্যের বিকাশ, চর্যাপদ, মনসামঙ্গল, শ্রী কৃষ্ণ কীর্তন এবং বৈষ্ণব
পদাবলী নিয়ে। এসব নিয়েই আলোচনাটা বেশী হত। আইন পেশায় আসার পর মাঝে
মাঝে আমার চেম্বারেও চলত আড্ডা। কখনো প্রেসক্লাবে। আমি অবাক হয়ে যাই যিনি
দীর্ঘদিন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছেন, ব্যক্তিজীবনে একজন আদর্শ শিক্ষকের
পাশাপাশি একজন ধর্মভীরু মানুষও। অথচ রাজনৈতিক দর্শন মার্কসবাদ -লেলিন বাদ সাহিত্যে আগ্রহ পৌরানিক কাহিনীর পাশাপাশি মহাভারত, বৈষ্ণব পদাবলী,শ্রী কৃষ্ণ কীর্তনে। এ বৈপরিত্য নিয়ে বহুবার মজা করে প্রশ্ন করেছি, তার সহজ সরল জবাব পৌরানিক
কাহিনী,লোক কাহিনী এবং আদর্শ ভিত্তিক Form and Content বাংলা সাহিত্যকে
অনেক সমৃদ্ধ করেছে। তিনি বলতেন বৈষ্ণব পদাবলী ও শ্রী কৃষ্ণ কীর্তনকে আমি
সাহিত্যমুল্য দিয়ে বিচার করি। কারন তখনকার সময়ে এগুলো বাংলা সাহিত্যের
শিক্ষার্থীদের পাঠ্য ছিল।
সুলতান ভাই ক্লাশে পড়াতেন সৈয়দ
ওয়ালিউল্লাহর লালসালু এবং মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি। ভন্ড
মজিদকে এবং কুবেরকে শিক্ষার্থীদের সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করতেন যেন
চরিত্রের সাথে মিলে মিশে নিজেই একাকার হয়ে যেতেন। এমনকি শিক্ষার্থীরা তাকে আড়ালে আবডালে তাকে ভন্ড মজিদ বা কুবের স্যার বলে মজা করতেন।
সংসপ্তক এবং কোথাও কেউ নেই নাটক দুটি আমাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এ নাটকে
আসাদুজ্জামান নুর এবং হুমায়ুন ফরিদির মত অভিনেতারাই চরিত্রের সাথে
মিলেমিশে বাকের ভাই হতে পারেন বা কানকাটা রমজান হতে পারেন,আজীবন বেচেও
থাকতে পারেন আমাদের স্মৃতিতে। কিন্তু একজন শিক্ষক কতটা দক্ষ, কতটা জনপ্রিয়
হলে চরিত্রের সাথে মিশে যেতে পারেন এটা আমার বোধগম্য নয়।
সুলতান
আহমেদ আজ সকালে আমাদের মাঝ থেকে চির বিদায় নিয়েছেন। একজন আদর্শ শিক্ষক
হিসাবে তিনি তার সহকর্মী ও প্রিয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেচে থাকবেন
শ্রদ্ধায় এবং ভালবাসায়। তবে আমার বিশ্বাস, লাল সালুর মজিদ এবং পদ্মা নদীর
মাঝি'র কুবের তাকে শিক্ষার্থীদের মাঝে বাচিয়ে রাখবে যুগের পর যুগ।
আমি প্রিয় সুলতান আহমেদ এর রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। পরিবারের প্রতি জানাচ্ছি গভীর সমবেদনা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন